Term Paper Part 5
সুড়ঙ্গ : সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর চার খানা নাটকের মধ্যে ভিন্ন স্বাদের সৃষ্টি ‘সুড়ঙ্গ’(১৯৬৪)নাটক ।তার ঘোষনা অনুযায়ী নাটকটি কিশোর কিশোরীদের জন্য রচিত এবং এর উদ্দেশ্য দুটি,প্রথমত-কিশোর উপযোগী একটি নাটক রচনা করা।দ্বীতিয়ত,আত্নমগ্ন ও সহজ বিশ্বাসপ্রবন পাঠককে পরিতৃপ্ত ও পরিতুষ্টি দান করা।‘সুড়ঙ্গ’ নাটকের কাহিনী গড়ে উঠেছে রেজ্জাক সাহেবের পনের-ষোল বছরের কন্যা রাবেয়াকে ঘিরে।রেজ্জাক্সাহেব রাবেয়ার বিয়ের আয়োজন করেছেন।কিন্তু বিয়ের পূর্বে রাবেয়ার একটি উপসর্গ দেখা দিয়েছে।সে খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়ে সারাক্ষন নিজের ঘরে শুয়ে থাকে,কাউকে তার ঘরে ঢুকতে দেয় না।মেয়ে অসুস্থ মনে করে বাবা চিকিৎসক ডাকলেন,সবৈব পরীক্ষা- নিরীক্ষা করে ডাক্তার তাকে সম্পূর্ন সুস্থ বলে রায় দিলেন।বাবা বোধ করলেন নিশ্চই মেয়ের বর পছন্দ হয় নি।কিন্তু তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেল,বিয়েতে তার সম্মতি আছে।মূলত রাবেয়ার রোগী সাজার ভিন্ন এবং তা ভিন্ন এক দূর্দমনীয় কৌতুহল,অজানা রহস্য উন্মোচনের অপার আগ্রহ।বিষয়টি হচ্ছে-রাবেয়ার ঘরের পুরানো আলমারির নিচে গুপ্তধন আছে।দু’দিন ধরে এক যুবক সুরঙ্গ কেটে চলেছে সেই গূপ্তধনের আশায়।খননের শব্দ রাবেয়াকে অভিভূত ও কৌতুহলী করেছে,একটি চূড়ান্ত সাফল্য প্রত্যক্ষের জন্য সে উৎকর্ন হয়ে আছে,তাই সে ঘর-বিছানা ছাড়ছে না।এরই মধ্যে রাবেয়ার চাচাত ভাই কলিম ফকিরের ছদ্মবেশে রাবেয়ার চিকিৎসার বাহানায় ঘরে ঢোকে।ফকিরগিরি করতে সে খুন্তি ও শাবল নিয়ে এসেছে।অন্য কেউ না বুঝলেও রাবেয়া বুঝেছে,গুপ্তধনের খবর কলমের জানা-সে উদ্দেশ্যেই সে এসেছে।কিন্তু রাবেয়ার তাতে কোনো আগ্রহ নেই,সে রহস্যের মধ্যে ডুবে থেকে রোমাঞ্চিত হতে চায়।সুড়ঙ্গ পথে শেষ পর্যন্ত যুবুক ও কলিম উভয়েই পৌছেছে কিন্তু গুপ্তধন প্রাপ্তির ভাগ্য তাদের হয় নি।কেননা সিন্দুক শূন্য।
‘সুরঙ্গ’ নাটকটিকে কেউ কেউ রুপক নাটক বলেছেন।তাদের মতে-যুবক ও কলিম উভয়েই রাবেয়াকে চায়,প্রত্যাশা করে তার কুমারী হৃদয়ের অখন্ড প্রেম।কিন্তু তাদের আত্ননিবেদন নিজেকে উপস্থাপন করার কৌশল এক নয়।যুবক সুরঙ্গ কেটে অর্থাৎ ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের দীর্ঘ পরীক্ষারয় উত্তীর্ন হয়েই রাবেয়ার সামনে নিজেকে নিবেদন করে, কলিম ধৈর্যহীন,আকষ্কিক,ছদ্মবেশ আশ্রয়ী।
রুপক নাটকে নাট্যকারের অন্বিষ্ট হচ্ছে দৃশ্যমান,স্পর্শযোগ্য রুপকে সামনে রেখে রুপান্তরের ব্যঞ্জনা সৃষ্টি।‘সুড়ঙ্গ’ নাটকে রাবেয়া চরিত্রটি অবিকশিত,একটি বিশেষ অনুভূতির আবর্তে সে বন্দী।গুপ্তধন উদ্ধার-কর্ম প্রত্যক্ষ করে আনন্দিত ও শিহরিত হওয়ার বাইরে তার আর কোন অনুভূতি নেই।
‘সুড়ঙ্গ’ নাটকটির চরিত্রায়ন প্রক্রিয়া, অন্তর্গত পরিচর্যা ও ভাষাশৈলী নির্মানই একে দান করেছে শিল্প গৌরব।নাটকটির লক্ষ্য গুপ্তধন হলেও সেই আবহ নির্মিত হয়েছে যুবকের মাধ্যমেই।কিন্তু নাট্যকার তাকে রেখেছেন দৃশ্যের অন্তরালে।অনেকে নাটকটিকে রুপক বলেছেন।কিন্তু রুপক নাটকে যে অতীন্দ্রিয়ের সাধনা বা রুপ থেকে রুপান্তরে উপনীত হওয়ার অভিলাষ লক্ষ করা যায় – তা এ নাটকে নেই।
রুপক নাটকে যেভাবে ঘটনা রুপায়নের অনিবার্য ও আবেগদীপ্ত শব্দ ব্যবহার করা হয় ,ভাষার চিত্রময়তা ও সঙ্গীতিক ব্যঞ্জনা সৃষ্টির মাধ্যমে যেভাবে দূরত্বের সত্যতর জগৎ কে আভাসিত করা হয় ‘সুড়ঙ্গ’-এ তা প্রযুক্ত হয় নি।
নাট্যকার হিসাবে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সফলতাঃ- কাব্যেষু নাটকং রম্যম-রঙ্গমঞ্চের মাধ্যমে অভিনয় শিল্পীদের সাহায্যে সুনির্দিষ্ট বাস্তববোধ সম্পন্ন চরিত্রের মাধ্যমে মানবের চলমান জীবনের সুখ-দুঃখকে যখন বাস্তবতা ভিত্তিক সংলাপের বিনিময়ে দর্শকের দৃষ্টির সামনে উপস্থিত করা হয় তখন তা হয় নাটক।ইংরেজিতে বলা যায়,Drama is the creation and representation of life in terms
of theatre.
নাটক একটি যৌথ শিল্প,এখানেই সাহিত্যের অন্যান্য শাখার সাথে এর পার্থক্য।সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।তার প্রত্যেকটি সাহিত্যকর্মই নিরীক্ষাধর্মী।নাটকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ভাষা ব্যাবহার একেবারেই অভিনব ও প্রতীকী।পাশ্চাত্য সাহিত্যের বিভিন্ন কাঠামো ও আঙ্গিক তিনি তার গল্প, উপন্যস, নাটকে প্রয়োগ করেছেন।সাহিত্যের যে কোন ক্ষেত্রে এই যে নব নব নিরীক্ষা এসবই সাহিত্যকে নতুন মাত্রা দেয়, সাহিত্যকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়।তবে বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যে পরীক্ষা-নীরিক্ষার বিষয়টিতে অনেক শ্লথ গতি ধরা পড়ে।ওয়ালীউল্লাহ একদিকে চলমান জীবনস্থবির নিভাজ রেখা টেনে কাহিনী বর্ননা করে যান।আবার এর মধ্যে মাঝে মাঝে হিরে দ্যুতির মত ঝলকে ওঠে অনতিদূরে তীর্যক জীবন প্রশ্ন।বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যে অ্যাবাসার্ড নাটকের জন্মদাতা সম্ভবত তিনিই। ‘বহিপীর’-কে রঙ্গ ব্যাঙ্গ প্রবণ কমেডি বলে।সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ভাষা সর্বদাই বহুমাত্রিক অস্বচ্ছ ও অস্পষ্ট ।তিনি তার রচনায় মানব হৃদয়ের গভীরে লুকানো মৌলিক অথবা অর্জিত অন্ধকারে কখনো বা প্রতীকের মাধ্যমে বা বাইরে বের করে দেখান।লেখক সুড়ঙ্গ নাটকে লেখক প্রতীকী দৃশ্য পটের মাধ্যমে চরিত্র সমূহের অন্তর্নিহিত ভাবকে তুলে ধরেছেন। অয়ালীউল্লাহর সবচেয়ে সফল ও সজীব নাটক তরঙ্গভঙ্গ।কি বিষয়বস্তু নির্বাচনে, কি আঙ্গিক নির্মানের অভিনবত্বে, কি উপস্থাপনার গুনে সবদিক থেকেই এই নাটক তার নাট্য নীরিক্ষার এক প্রামান্য দলিল।অন্যদিকে এত জটিল কাহিনী বিস্তার ও চরিত্র চিত্রন সত্ত্বেও এ নাটকে ব্যাবহৃত ভাষার ব্যাবহার আশ্চর্য রকম গীতল।এখানেই তিনি নাট্যকার হিসাবে তার মুন্সিয়ানার পরিচয় রেখেছেন।সুড়ঙ্গ এবং তরঙ্গভঙ্গ নাটকে যে অ্যাবাসার্ড শিল্পরীতির সূচনা ও চর্চা শুরু করেছিলেন, নাট্যকার উজানে মৃত্যু নাটকে এসে তার শিল্পিত চর্চার সুষম প্রয়োগ ঘটিয়েছেন।এক কথায় এ নাটকটি তার প্রতিভার সর্বোচ্চ উতকর্ষতা প্রমান করেছেন।ড.জীনাত ইমতিয়াজ আলী এ নাটকটি সম্বন্ধে বলেছেন, উজানে মৃত্যু যথার্থই বাংলা নাট্যসাহিত্যে এক ব্যাতিক্রমী সৃষ্টি, অ্যাবাসার্ড ধর্মী বক্তব্য ও সে অনুযায়ী আঙ্গিক নির্মান, ব্যক্তির অবচেতনায় স্তরীভূত ভাব-অনুভাবের রুপকল্প রচনা, শব্দ ও নৈশব্দ এবং রুপক-প্রতীকের মেধাবী প্রয়োগ-সাফল্যে এক অনতিক্রান্ত নাটক।
উপসংহারঃ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ আমাদের পাঁচ দশকের এক বিরল,নিরীক্ষাপ্রিয় ও মৌলিক নাট্যপ্রতিভা।সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘বহিপীর’ তাঁর নাট্যপ্রতিভার উন্মেষপর্বের রচনা,তবুও চরিত্র ও সংলাপ নির্মান কুশলতা,সাংগঠনিক অন্তর্বয়নের মৌলিকত্বে তাঁর সমকালীন নাট্যধারা থেকে স্বতন্ত্র।শিল্পীর বিশ্বপ্রসারী জীবনাদর্শ,তার পরবর্তীকালের শিল্প সচেতনতা,তার ব্যাপক ও গভীর অস্তীত্ব অন্বীক্ষার স্বরুপ ও সত্যার্থ ‘বহিপীর’ এ খুঁজে পাওয়া যায়। লেখকের নাটক তার জীবনচর্চা,অস্তীত্ব অভীপ্সু জীবন জিজ্ঞাসারই নান্দনিক ভাষ্য। তরঙ্গভঙ্গ নাটকে তিনি বিশ্বপ্রসারী শিল্প সৃষ্টিতে সফল।বহিপীর-এর মাধ্যমে যে নাট্যবৃত্তির সূচনা তরঙ্গভঙ্গ-এ প্রকাশবাদী নাট্যরীতির নির্বাচিত ব্যবহারের মাধ্যমে সেই পরীক্ষপ্রবন ও গতিশীল শিল্পচেতনার উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে।মূলত নাট্যকার হিসেবে ওয়ালীউল্লাহ সব সময়ই ব্যতিক্রমী হয়ে ওঠার সাধনা করেছেন,আন্তর্জাতিক নাট্য পরিধিকে স্পর্শ করাই ছিল তার ঐকান্তিক এষনা,তার প্রান চঞ্চল সত্তার স্বাভাবিক প্রবনতা।সতর্ক বিবেচনায় তাই স্পষ্ট আনুধাবন করা যায় যে,সুড়ঙ নাটকে নাট্যকারের মানষে একটি নিঃশব্দ প্রস্তুতি চলছিল,দেশীয় পরিধি অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক নাট্যচিন্তা সংশ্লেষ ও সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে একটি একান্ত নিজস্ব নাট্যবিশ্ব নির্মানে তিনি ক্রমশ অভিনিবিষ্ট ও ঐকান্তিক হয়ে উঠেছিলেন যার প্রকাশ,প্রাকরণীক সাফল্য,শিল্প প্রকর্ষ ও শিল্পশুদ্ধতাকে ধারন করে আছে ‘সুরঙ্গ’ নাটকে।লৌকিক পরিবেশকে ব্যাবহার করে,পরিচিত দৃশ্যসজ্জার মাধ্যমেই নাট্যকার মঞ্চ সাজিয়েছেন।তার সজ্জিত মঞ্চ সাধারন ঊর্ধ এক মনোবাস্তবতার জন্ম দিয়েছে।মূলত নাট্যকারের মঞ্চসজ্জা অ্যাবাসার্ড পদ্ধতিতে বিন্যস্ত।উজানে মৃত্যুর প্রকিত মঞ্চ বাইরে নয়,দর্শক,পাঠকের অন্তরে,তাদের মেধা ও অনুভূতিলোকেই এর অবস্থান।
No comments